ছোট বেলা থেকে আমার একটা কাল্পনিক জগত ছিল সমুদ্রকে ঘিরে। আমার কাছে সমুদ্র মানেই চোখে ভেসে উঠত একটি ছবি। বিশাল এক বালুতট, ঠিক আমাদের কক্সবাজার সৈকতের মত দীর্ঘ, কিন্তু তার কূল ঘেঁষে আছে কিছু ছোট ছোট ঝাউবন আর সুদীর্ঘ নারিকেল গাছের সারি। সৈকতের প্রস্থ প্রায় শ’পাঁচেক মিটারতো হবেই। সেই সৈকতে আমি একটি বেঞ্ছিতে শুয়ে আছি, মাঝরাত, আকাশে এক বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ। জোছনায় সমুদ্রের পানি চিকচিক করছে। দূরে ছোট ছোট জেলে নৌকা দেখা যায়। জোছনার আলো ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় আলো নেই সেই সৈকতে। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় শব্দ নেই সেই স্থানে।
কিন্তু বিধিবাম, প্রথমবার সমুদ্র দেখতে গিয়ে আমার আশৈশব লালিত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার। সেবার প্রথমে গিয়েছিলাম পতেঙ্গা, সেখান থেকে কক্সবাজার এবং টেকনাফ। হ্যাঁ ইনানী সি-বিচেও গিয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও আমার সেই স্বপ্নের সৈকতের দেখা পাই নাই। অনেকে সেবার বলেছিল যে সেন্টমার্টিন গেলে তুমি তোমার স্বপ্নের সৈকত দেখতে পাবে। কিন্তু অনেক কারনে আর সেন্টমার্টিন যাওয়া হল না। হুমায়ুন আহমেদের “দারুচিনি দ্বিপ” এর মত আমার প্রতিবারই সেন্টমার্টিন যাওয়া থেমে গেছে টেকনাফ পর্যন্ত গিয়ে।
সেই গল্পে আজ আর নাই গেলাম। এবার মূল গল্পে আসি।
গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ একটা ইভেন্ট রাখলো “নারিকেল জিঞ্জিরায় পূর্ণিমায় মধুচন্দ্রিমা অথবা জোছনা বিলাস”!!! গ্রুপের এক নিউলি ম্যারিড কাপল এর কথা মাথায় রেখে। ফ্যাসাদে পরলাম আমরা কর্মজীবীরা। দুইদিনের ছুটি ম্যানেজ করে যোগ দিলাম ইভেন্টে।
বৃহস্পতিবার রাতের বাস ছিল, ঢাকা টু টেকনাফ। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ফকিরেরপুল থেকে গাড়ি ছাড়ল, দলের চারজনকে ফেলে রেখে! সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, পুরো ঢাকা শহর জ্যামে প্যাক। দলনেতা রবিউল হাসান খান মনা সবাইকে ফোন করে ৪টার দিকেই এই খবর জানিয়ে দেয়ার পরও ঐ চারজন লেট করে বের হওয়ার খেসারত দিল বাস মিস করে। যাই হোক আমরা বাকী ১৬জনের দল রওনা হলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে।
পথে কোন তেমন একটা জ্যামে না পরায় আমরা সকাল আটটা নাগাদ টেকনাফ এর সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের ঘাটে পৌঁছে গেলাম।
সেখানে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা সেরে আমরা “কুতুবদিয়া” নামক জাহাজে করে রওনা হলাম সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ। বলে রাখা ভালো সিজনে এই রুটে চারটি জাহাজ চলাচল করে। টেকনাফ থেকে ছাড়ে সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ আর টেকনাফ থেকে দুপুর তিনটা নাগাদ।
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এই জাহাজগুলো বন্ধ থাকে। তখন স্পীড বোট আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা হয় একমাত্র ভরসা, যদিও তা রিস্কি।
জাহাজ ছাড়ার কিছু সময় পর নাফ নদী ছেড়ে আমাদের জাহাজ পড়ল বঙ্গোপসাগরের জলে।
সাথে সঙ্গী হয়ে উড়তে থাকলো মায়াকারা সিগালের ঝাঁক। শ’খানেক সিগালের উরন্ত ঝাঁক আর সাগরের বুক চিরে সফেদ ঢেউ দেখতে দেখতে পৌঁছলাম নারিকেল জিঞ্জিরা। ও হ্যাঁ পুরো সময় জুড়ে চারটি জাহাজ একসাথে চলেছে, আর তাই জেটিতে ভিড়লোও একসাথে।
কিন্তু লম্বাটে জেটি হওয়ায় একটির গাঁয়ে আরেকটি, এভাবে ভিড়ল; আমাদেরটা পড়ল তিন নাম্বারে। আড়াই ঘণ্টার সমুদ্রযাত্রা’র আনন্দ মাটি করে দিল জলযান থেকে অবতরণের এই যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া। পুরো এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে এবং ভিড়ের মাঝে আলুভর্তা হয়ে সেন্টমার্টিন এর মাটিতে পা রাখলাম বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ। কিন্তু একি! এই রুপ স্বপ্নের সেন্টমার্টিন এর? আশাহত হলাম। বাজার মনে হল একটা, মানুষ আর মানুষ, দোকানপাট, হই-হুল্লোড়... সব মিলে বিশ্রী অবস্থা।
যাই হোক আগে থেকে আমাদের জন্য “সমুদ্রপুরী রেস্টহাউজ” বুকিং করে রেখেছিলেন ‘আন্ডার ওয়াটার স্কুবা ড্রাইভার’ মুজিব ভাই। জেটি সংলগ্ন সমুদ্র সৈকত ঘেঁষা রেস্ট হাউজে আমরা ষোল জনের দল লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। অনেকে গোসল সেরে নিলাম, ছেলেরা দৌড় দিলাম মসজিদের দিকে... জুম্মা নামাজ ধরতে।
ভ্রমণকালঃ ১৫ মার্চ, ২০১৪
আগের পোস্টঃ